অফিস ডেস্ক
পাকিস্তানের কূটনৈতিক অঙ্গনে সাম্প্রতিক সাফল্যকে অনেকে “নতুন যুগের সূচনা” বলে বর্ণনা করছেন। একদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাকিস্তানমুখী অবস্থান, অন্যদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে ‘স্ট্র্যাটেজিক মিউচুয়াল ডিফেন্স অ্যাগ্রিমেন্ট’—দুই ঘটনাই দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
গত ছয় মাসে পাকিস্তান একের পর এক কূটনৈতিক অর্জনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের অবস্থান নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করে তারা ভারতের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য চুক্তি,
ইরানের সঙ্গে জ্বালানি ও বাণিজ্য সহযোগিতা,
এবং চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার—সব মিলিয়ে ইসলামাবাদের নীতিতে এসেছে বহুমাত্রিকতা।
অর্থনীতিতেও পাকিস্তান কিছুটা স্থিতিশীলতা পেয়েছে। আইএমএফ থেকে ২৪তম ঋণ পাওয়ার পর টেকনোক্র্যাট প্রশাসনের দক্ষতায় দেশটি পুনরুদ্ধারের পথে। যদিও বালুচিস্তান ও আফগান সীমান্তে তালেবানঘেঁষা সন্ত্রাসী হামলা বেড়েছে, তবুও ইসলামাবাদ কূটনৈতিক ভারসাম্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
ইসরাইলের কাতারে হামাস অফিসে হামলার পর রিয়াদের নিরাপত্তা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন চুক্তি করে সৌদি আরব। এতে বলা হয়েছে, “এক দেশের ওপর হামলা হলে অন্য দেশ সেটাকে নিজেদের ওপর হামলা হিসেবে গণ্য করবে”—যা ন্যাটো-স্টাইল প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পাকিস্তান এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তার নতুন স্তম্ভে পরিণত হচ্ছে। বর্তমানে সৌদি আরবে দুই হাজার পাকিস্তানি সেনা প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিচ্ছেন। পাশাপাশি রিয়াদ থেকে ইসলামাবাদ পেয়েছে তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ এবং গোয়াদরে ১০ বিলিয়ন ডলারের তেল শোধনাগার প্রকল্পে বিনিয়োগ।
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর দুই দেশের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতার মাধ্যমে পাকিস্তান আবারও ওয়াশিংটনের আস্থায় ফিরেছে।
পাকিস্তানি গোয়েন্দারা আইএস-খোরাসানের এক নেতাকে ধরতে সহায়তা করেছিল, যা সেন্টকম প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলা “অসামান্য সহযোগিতা” হিসেবে উল্লেখ করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ট্রাম্প ও পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের মধ্যে বৈঠক, এবং প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে একাধিক সাক্ষাৎ সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন পাকিস্তানের তেল ও খনিজ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
ট্রাম্প–মোদি সম্পর্ক সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শীতল হয়েছে। রাশিয়ার সস্তা তেল কেনার জেরে ট্রাম্প ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন, যা নয়াদিল্লিকে ক্ষুব্ধ করেছে। মার্কিন কর্মকর্তারাও ভারতের অর্থনীতি নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছেন।
এই ফাঁকে পাকিস্তান ট্রাম্পের গাজা শান্তি পরিকল্পনা ও অস্ত্রবিরতিতে সমর্থন জানিয়ে ওয়াশিংটনের নতুন প্রিয় অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন—এই অর্জনগুলো অস্থায়ীও হতে পারে। পাকিস্তানের তেল রিজার্ভ ও খনিজ সম্পদ নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে, এবং বালুচিস্তানের অস্থিতিশীলতা বিদেশি বিনিয়োগের পথে বড় বাধা হতে পারে।
পাকিস্তান এখন এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলায় নেমেছে—চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখা তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি কি ক্রমাগত রূপ বদলাবে, নাকি বিভাজনই হবে স্থায়ী?—এই প্রশ্নই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
একই সঙ্গে, সৌদি-ইরান সম্পর্ক, ভারত-চীন উত্তেজনা ও মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত—সব মিলিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এখন অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার মধ্যে এক নতুন কূটনৈতিক অধ্যায় শুরু করেছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে পাকিস্তান।
সূত্র: ফরেন পলিসি