শিরোনাম:

শরিফ ওসমান হাদি: একটি নাম, একটি বিপ্লব, একটি অমর প্রতীক

সংবাদ৫২ ডেস্ক
অফিস ডেস্ক
প্রতিবেদন প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বার ২০২৫ | সময়ঃ ০৬:২৭
photo

 

শরিফ ওসমান হাদি—শুধু কোনো ব্যক্তিনাম নন, তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক জ্বলন্ত বিপ্লবী প্রতীক। অন্যায়কে প্রশ্ন করা, ফ্যাসিবাদের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানো এবং নির্ভীকভাবে সত্য উচ্চারণ—এই সাহসী মানসিকতারই প্রতিচ্ছবি ছিলেন তিনি। জুলাই বিপ্লবের উত্তাল দিনগুলোতে যখন ভয় ও অনিশ্চয়তা মানুষের বিবেককে গ্রাস করছিল, তখন হাদি দাঁড়িয়েছিলেন দৃঢ়তার অবয়ব হয়ে। মঞ্চে কিংবা মাইক্রোফোনের সামনে তার কণ্ঠে ছিল না কোনো জড়তা, চোখে ছিল না ভয় কিংবা সংশয়। তিনি বিশ্বাস করতেন—সত্য বলার ঝুঁকি আছে, কিন্তু নীরব থাকার দায় আরও ভয়াবহ।

সেই বজ্রকণ্ঠকেই থামিয়ে দিয়েছে আততায়ীদের গুলি। গত ১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্সকালভার্ট রোডে মোটরসাইকেলে আসা দুই হামলাকারীর একজন চলন্ত রিকশায় থাকা ওসমান হাদির মাথায় গুলি করে। টানা আট দিনের মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শেষে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে বৃহস্পতিবার রাতে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে মুহূর্তেই শোক ও ক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা থেকে শুরু করে সারা দেশ।

ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। বাবা ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম। ঝালকাঠির এন এস কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। পরবর্তীতে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষার একটি কোচিং সেন্টারে পাঠদান করতেন। শিক্ষাজীবন থেকেই তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকলেও কোনো প্রচলিত রাজনৈতিক দলে যুক্ত ছিলেন না।

মূলত চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানই তাকে রাজনীতির সম্মুখসারিতে নিয়ে আসে। জুলাই অভ্যুত্থান এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তিনি ছিলেন সামনের সারির সাহসী সংগঠক। রাজধানীর রামপুরা এলাকায় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। জুলাই শহীদদের অধিকার রক্ষা, আধিপত্যবাদবিরোধী অবস্থান এবং ‘ন্যাশনাল অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ইউনিটি’র ব্যানারে রাজপথে তার উপস্থিতি ছিল নিয়মিত ও দৃঢ়।

এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তিনি গড়ে তোলেন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। সংগঠনটির লক্ষ্য ছিল আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। নিপীড়িত মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠা এই মঞ্চের প্রধান কণ্ঠ ছিলেন হাদি নিজেই। তার উচ্চারণ ছিল আগুনের মতো—কিন্তু সে আগুন ধ্বংসের জন্য নয়, অন্ধকার ভেদ করে আলো ছড়ানোর জন্য। তিনি বলতেন, ‘ভয় পেলে চলবে না, ইতিহাস ভীরুদের ক্ষমা করে না।’

হুমকি, চাপ কিংবা শত্রুতার ভয় তাকে দমাতে পারেনি। একাধিকবার তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘বুলেট ছাড়া কেউ আমাকে থামাতে পারবে না।’ শেষ পর্যন্ত সেই বুলেটই তার মস্তিষ্ক ভেদ করে রক্ত ঝরিয়েছে বাংলাদেশের বুকের ওপর। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এভারকেয়ার, সেখান থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর—এই যাত্রায় সঙ্গী হয়েছিল কোটি মানুষের প্রার্থনা। তবে নিয়তির ডাক উপেক্ষা করা যায়নি।

হাদি নিজেও শহীদি মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাকে যদি হত্যা করা হয়, কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়ে যদি নতুন বাংলাদেশ গড়ে ওঠে, তবে আগামী হাজার বছর মানুষ আপনার জন্য দোয়া করবে।’ তার জীবন ও মৃত্যু যেন সেই কথারই বাস্তব প্রতিফলন।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। প্রচলিত রাজনীতির বাইরে গিয়ে ‘চা-শিঙাড়া’ আড্ডার মতো ব্যতিক্রমী কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামোগত দুর্বলতার সমালোচনা করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন এবং পুরোনো ধারার রাজনীতিকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেন।

ওসমান হাদি রেখে গেছেন স্ত্রী ও একমাত্র শিশুসন্তান। তার অকালমৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গন, ছাত্রসমাজ ও অসংখ্য অনুসারীর মধ্যে গভীর শোক নেমে এসেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন বিক্ষোভ ও সমাবেশের মাধ্যমে তার হত্যার বিচার দাবি করছে।

হাদির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিপ্লবী রক্তে উজ্জীবিত তরুণ নেতা ওসমান হাদি ছিলেন প্রতিবাদের এক আইকন, যিনি দেশপ্রেম, ধৈর্য ও দৃঢ়তার অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, আধিপত্যবাদ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে হাদির সাহসী সংগ্রাম এ দেশের তরুণদের জন্য চিরন্তন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশে শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন, ‘শহীদ ওসমান হাদির রক্তের শপথ, আজ থেকে আমরা প্রত্যেকে ওসমান হাদি।’ তাদের কণ্ঠে ছিল প্রতিরোধের অঙ্গীকার, রাজপথে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়।

শরিফ ওসমান হাদি চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন একটি স্বপ্ন—ইনসাফভিত্তিক বাংলাদেশ, যেখানে রাষ্ট্র মানুষের বিরুদ্ধে নয়, মানুষের পাশে দাঁড়াবে। তার অনুপস্থিতি শুধু একজন নেতার শূন্যতা নয়; এটি এক সাহসী রাজনৈতিক ভাষার অভাব। তবুও তার জীবন, তার কণ্ঠ ও তার আত্মত্যাগ নতুন প্রজন্মের পাথেয় হয়ে থাকবে—এক অমর নাম, এক অবিস্মরণীয় প্রতিবাদ।

শেয়ার করুন