১১ই ফেব্রুয়ারী বিশ্ব ইউনানি দিবস
এম এ হান্নান স্টাফ রিপোর্টার দৈনিক প্রভাতী বাংলাদেশ
গোবিন্দগঞ্জ
ঐতিহ্যের আলোয় প্রাকৃতিক চিকিৎসার নবজাগরণ
বিশ্ব ইউনানি দিবস প্রতি বছর ১১ই ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয়, যা প্রখ্যাত ইউনানি চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী হাকিম আজমল খান (১৮৬৮-১৯২৭)-এর জন্মবার্ষিকীর স্মরণে পালন করা হয়। এই দিনটি ইউনানি চিকিৎসাব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, ঐতিহাসিক অবদান এবং আধুনিক যুগে এর প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে। ইউনানি চিকিৎসা কেবল একটি চিকিৎসাপদ্ধতি নয়, বরং এটি প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাত্রার একটি দর্শন।
ইউনানি চিকিৎসার উৎস প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসাবিদ্যা, যা হিপোক্রেটিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৭০) এবং গ্যালেন (খ্রিস্টপূর্ব ১২৯-২১৬)-এর তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীতে ইসলামী স্বর্ণযুগে (৮ম-১৩শ শতাব্দী)
ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭), আবু বকর আল-রাজী (৮৬৫-৯২৫), এবং ইবনে জাকারিয়া আল-রাজী-এর মতো মনীষীরা এটিকে পরিমার্জিত করেন। ভারতে এর প্রসারে হাকিম আজমল খান ও হাকিম আব্দুল হামিদ (১৯০৮-১৯৯৯)-এর ভূমিকা অগ্রগণ্য। হাকিম আজমল খান ১৯২৭ সালে দিল্লিতে তিবিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করে ইউনানিকে আধুনিক শিক্ষার সাথে সংযুক্ত করেন।
এই চিকিৎসাপদ্ধতি আখলাত-ই-আরবা
(চারটি দেহধাতুর ভারসাম্য)-এর তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত:
১. দাম (রক্ত),
২. বাল্গম(শ্লেষ্মা),
৩. সফরা(পিত্ত),
৪. সাওদা(কৃষ্ণ পিত্ত)।
ইউনানির মতে, এই ধাতুগুলির ভারসাম্যহীনতাই রোগের মূল কারণ। চিকিৎসার লক্ষ্য হলো "তাবিয়াত" (দেহের স্বাভাবিক স্ব-নিরাময় ক্ষমতা) জাগ্রত করে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। এটি প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা (হিফজান-ই-সেহাত) এবং প্রাকৃতিক উপায়ে নিরাময়এর উপর গুরুত্ব দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ১৯৭৮ সালের আলমা-আটা ঘোষণা-তে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাপদ্ধতির একীকরণের কথা উল্লেখ করে। ২০০২ সালে WHO-এর প্রথাগত চিকিৎসা কৌশল (Traditional Medicine Strategy)-এ ইউনানিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ইউনানি চিকিৎসা পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত:
১. ইলাজ বিল গিজা (খাদ্য ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনা),
২. ইলাজ বিল দাওয়া (ভেষজ ও খনিজভিত্তিক ওষুধ),
৩. ইলাজ বিল তাদবির (শারীরিক থেরাপি: হিজামা/কাপিং, দালাক/ম্যাসাজ),
৪. ইলাজ বিল ইয়াদ (অস্ত্রোপচার),
৫. ইলাজ বিল তালিম(জীবনযাত্রার পরিবর্তন)।
ইউনানি চিকিৎসা হলো প্রাচীন জ্ঞান ও আধুনিক বিজ্ঞানের মিলবন্ধন। ২০২৩ সালে ভারত সরকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইউনানি মেডিসিন (NIUM)-এর মাধ্যমে ১০০টির বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে, যা ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ও চর্মরোগে এর কার্যকারিতা প্রমাণ করে। বিশ্ব ইউনানি দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে আছে রোগমুক্তির চাবিকাঠি।
প্রকৃতিই সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক এই বিশ্বাসকে ধারণ করে আসুন, আমরা সবাই ইউনানির আলোকে ছড়িয়ে দিই।