ঢাকা: এক অনিশ্চয়তার শহর — বিয়ারিং প্যাডে মৃত্যুর পর আবারও প্রশ্ন, “এই শহরে জীবনের দাম কত?” বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি দুর্ঘটনা নয়, ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা জনিত হত্যাকাণ্ড
রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু—এই এক ঘটনার পর আবারও আলোচনায় এসেছে শহরটির অনিশ্চিত জীবনযাত্রা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে লিখছেন, “এই শহরে কেউ পড়ে মারা যায়, কেউ চাপায়, কেউ ইটে বা গার্ডারে—জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই।”
মতিঝিলে কাজ শেষে ফার্মগেটের পথে হাঁটতে হাঁটতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা আবুল কালাম (৪৫)। মেট্রোরেল পিলার থেকে খুলে পড়া ভারী বিয়ারিং প্যাড তার মাথায় আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। সোমবার জানাজা শেষে মরদেহ দাফন করা হয় শরিয়তপুরের নড়িয়ায়।
ছয় বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট আবুল কালাম দুই সন্তানের পিতা ছিলেন। তার মৃত্যু মুহূর্তেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, জন্ম দেয় তীব্র ক্ষোভ ও ক্ষরণ।
সরকার জানিয়েছে, ঘটনার তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং নিহতের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তবে নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ঢাকায় ঘটতে থাকা একের পর এক ‘ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার পরিণতি’।
“এই শহরে মানুষের জীবনই সবচেয়ে সস্তা”
বছরের পর বছর ধরে ঢাকায় এমন মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কেউ ময়লার গাড়ির ধাক্কায়, কেউ দুই বাসের চিপায়, কেউ বা ওপর থেকে ইট পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। সামাজিক মাধ্যমে কেউ লিখছেন, “ঢাকা শহরে জীবনের কোনো দাম নেই—যখন তখন উধাও হয়ে যেতে পারে।”
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংক কর্মকর্তা দীপান্বিতা বিশ্বাস দীপুর মৃত্যু হয়েছিল মগবাজারে—ওপর থেকে পড়ে আসা ইটের আঘাতে। ২০২২ সালের আগস্টে উত্তরে ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে নবদম্পতিসহ পাঁচজনের মৃত্যু নাড়া দিয়েছিল দেশজুড়ে। কিন্তু এসব ঘটনার কোনো দায়ী ব্যক্তির বিচার হয়নি।
আরও আগে, ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বাহিনীর বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ৩৫ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী—যা আজও শহরের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলোর একটি।
“এগুলো দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড”
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, “এই ধরনের মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়—এগুলো দায়িত্বে অবহেলা ও ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা জনিত হত্যাকাণ্ড। যাদের অনুমোদন, নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা দেখার দায়িত্ব, তাদের কখনো শাস্তি হয়নি বলেই এগুলো ঘটছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সমাজ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, “জীবনযাপন কেন্দ্রিক অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতার অভাবে ঢাকা এখন মৃত্যু ফাঁদের শহরে পরিণত হয়েছে। এখানে পথচারী বা যাত্রীর জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই।”
তার ভাষায়, “যে কোনো আকস্মিক মৃত্যুকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ধামাচাপা দেওয়া হয়। কিন্তু এগুলো আসলে ব্যর্থতা থেকে সৃষ্টি হত্যাকাণ্ড। জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে মুক্তি মিলবে না।”
“ভয় নিয়ে বাঁচা শহর”
ঢাকার সাধারণ নাগরিকরাও প্রতিদিন এই অনিশ্চয়তা নিয়ে বাঁচছেন।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন বলেন, “কাজে যেতে মোহাম্মদপুর থেকে উত্তরা যাই। প্রতিদিন মনে হয়—কোথাও কিছু পড়ে না যায় মাথায়।”
ফুটপাতে হাঁটেন আমিনুল ইসলাম। তার ভয়, “বাজারে গেলেও টেনশনে থাকি—কখন কি ভেঙে পড়ে মাথায়। বাইক, অটোরিকশা ফুটপাতে উঠে আসে। মরার ভয় নিয়ে বাঁচি।”
অবহেলার অবসান কবে?
বিশ্লেষকদের মতে, ঢাকায় ঘটে যাওয়া এসব আকস্মিক মৃত্যুর পেছনে আছে গভীর কাঠামোগত ত্রুটি, অবহেলা ও দায়মুক্ত সংস্কৃতি। প্রত্যেক ঘটনায় গঠিত হয় তদন্ত কমিটি, দেওয়া হয় ক্ষতিপূরণ, কিন্তু ফলাফল আসে না।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “দায়মুক্তির সংস্কৃতি শেষ না হলে ঢাকার রাস্তায় মৃত্যু থামবে না। কারণ এখানে দুর্ঘটনা নয়—দায়িত্বহীনতাই নিয়মে পরিণত হয়েছে।