সালাত, সিয়াম, সদাকাহ, হজ্ব, যাকাত যেমনি আলাদা-আলাদা ইবাদাত, এই ইবাদাত সমূহের জন্য যেমনিভাবে ফযিলত ও সাওয়াব বিদ্যমান রয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে দু’আর জন্য ও আলাদা ফজিলত ও সাওয়াব বিদ্যমান রয়েছে। শুধু তাই নয়, সালাত, সিয়ামের মত মৌলিক ইবাদাত সমুহ সম্প্রাদনের কথা মহান আল্লাহ পাক যেমনিভাবে পবিত্র কুরআনুল কারিমে বলেছেন, ঠিক একইভাবে দু’আর মত খুব গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত সম্পাদনের ব্যাপারে ও তিনি তাঁর বান্দাদেরকে আহ্বান করেছেন। সূরা মু’মিন-এর ৬০নং আয়াতে তিনি তাঁর বান্দাদেরকে আহ্বাণ করে বলেন, “তোমাদের রব বলেন, তোমারা আমার নিকট দু’আ কর, আমি তোমাদের দু’আ কবুল করব। নিশ্চই যারা আমার ইবাদাতে (আমার নিকট দু’আ করতে) অহংকার করে, তারা অপমানিত ও লাঞ্চিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।”
হাদিস শরিফেও এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাতের ব্যাপারে তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। নবী কারিম (সা.) বলেন, “নিশ্চই দু’আ-ই ইবাদাত।” এরপর তিনি কুরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত করেন, “তোমাদের রব বলেন, তোমারা আমার নিকট দু’আ কর, আমি তোমাদের দু’আ কবুল করব। নিশ্চই যারা আমার ইবাদাতে (আমার নিকট দু’আ করতে) অহংকার করে, তারা অপমানিত ও লাঞ্চিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” [তিরমিযি: ২৯৬৯]
নবী কারিম (সা.) দু’আ-কে শুধু ইবাদাত বলে ক্ষান্ত হননি, অন্য একটি হাদিসে তিনি দু’আকে ইবাদাতের মগজ বলেছেন। তিনি বলেন, ” দু’আ ইবাদাতের মগজ।” [ তিরমিযি:৩৩৭১]
প্রিয় পাঠক, কিছু সময়ের জন্য একটু কল্পনা করুন, দু’আ সহ সমস্ত ইবাদাত হলো মানব দেহের একটি মাথা। আর সেই মাথার মগজ হলো দু’আ। যেহেতু আপনি ও একজন শ্রেষ্ঠ মানব। এখন বলুন, আপনার কী অনুভূতি জাগ্রত হলো? আপনার কাছে কি আপনার মাথার মগজের মূল্য কম মনে হলো? হ্যা, যদি তাই হয়। তাহলে আপনি আর দেরি না করে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হন। তিনি আপনার পুরো মাথার মূল্য আর শুধু মাথার মগজের মূল্য কেমন বলে শুধু একবার শুনে আসুন। শুনার পর আপনার বিবেক যদি আপনার মনে বিস্মৃতবোধ জাগ্রত না করে, এরপর না হয় আপনি অচেতনে, অবহেলায় ও আবলীলায় এই বিষয়টিকে গুরুত্বহীন ভেবে এড়িয়ে চলুন!
দু’আর ব্যতিক্রমী কিছু বৈশিষ্ট্য :-
১. আল্লাহ পাক বান্দার দু’আতে স্বয়ং সাড়া প্রদান করেন। তিনি বলেন, “যখন কোন প্রার্থনাকারি আমার কাছে প্রার্থনা করে, তখন আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দেই (কবুল করি)।” [সূরা বাকারা:১৮৬]
২. দু’আ মহান রবের নিকট অধিক প্রিয় ও মর্যাদাপূর্ণ। নবী কারিম (সা,) বলেন, “আল্লাহর নিকট বান্দার দু’আর চেয়ে অধিক প্রিয় ও মর্যাদাপূর্ণ জিনিস আর নেই।” [তিরমিযি: ৩৩৭০]
৩. দু’আর হাত অধিক পূর্ণতা পাই। রাসূল (সা.) বলেন, ” নিশ্চই মহান আল্লাহ অত্যন্ত লাজুক ও দয়ালু। যখন কোন বান্দা তাঁর নিকট দু’হাত উঠিয়ে দু’আ করে, তিনি তার দু’হাত শূণ্য ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।” [তিরমিযি:৩৫৫৬]
৪. দু’আ মহান রবের সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম মাধ্যম। হাদিসে এর দৃষ্টান্ত হলো: “যে আল্লাহর নিকট দু’আ করে না, আল্লাহ তার উপর অসন্তুষ্ট হন। [তিরমিযি:৩৩৭৩]
৫. দু’আ রব্বে কারিমের রহমত লাভের বড় হাতিয়ার। রাসূল (সা.) বলেন, “যার জন্য দু’আর দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে ( অর্থাৎ, যাকে দু’আ করার তাওফিক দান করা হয়েছে) তার জন্য রহমতের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে।” [তিরমিযি: ৩৫৪৮]
৬. দু’আ ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক। আল্লাহর হাবীব (সা). বলেন, “কেবল দু’আ-ই ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। মানুষের উপকার ও কল্যাণের কাজে আয়ু বৃদ্ধি করে।” [তিরমিযি: ২১৩৯]
৭. দু’আ হলো দ্বীনের খুঁটি। হাদিস শরিফে এসেছে; “দু’আ হলো মুমিনের অস্ত্র, দ্বীনের খুঁটি এবং আসমান ও জমিনের নূর (আলো)।” [জামিউস সুন্নাহ: ৩৪১৪]
এছাড়া ও, দু’আর মাধ্যমে মহান মনিবের ইবাদাতে লিপ্ত হলে আত্মা প্রশান্তি লাভ করে, পেরেশানি দূর হয় ও মনের মাঝে বিচরিত বেদনার ভার কমে যায়।
দু’আ স্বতন্ত্র ইবাদাতের কারণ :
ধরুন, কোন এক লোক সালাত, সিয়াম ইত্যাদি ইবাদাত সম্পূর্ণ করল, এর বিনিময়ে সে কী পাবে? উত্তর হবে নিশ্চই সাওয়াব। এবার ধরুন, আরেক লোক মনিবের দরবারে দু’আ করল, এর বিনিময়ে সে নফল সালাত, সিয়াম ও যিকিরের মতই সাওয়াবতো পাবেনই; বাকি দু’আর ফল তার জন্য এক্সটা বোনাস। এই জায়গায় ফলাফলের বিবেচনায় এসে দু’আ যেন এক স্বতন্ত্র ইবাদাতে পরিনত হয়েছে।
রাসূলে কারিম (সা.)-এর হাদিস ও যেন এই ইঙ্গিত-ই বহন করে। “যখন কোন মুসলিম পাপ ও আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করা ছাড়া অন্য যে কোন বিষয়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করে মহান আল্লাহ তার দু’আ কবুল করে তাকে ৩টি বিষয়ের যে কোন একটি দান করেন। ১) তার প্রার্থিত বিষয় তাকে তাৎক্ষণিক দান করেন। ২) অথবা দু’আটিকে (দু’আর সাওয়াব) আখিরাতের জন্য রেখে দেন। ৩) অথবা দু’আর বিনিময়ে তার অন্য কোন বিপদ দূর করে দেন। একথা শুনে সাহাবিগণ বললেন, তাহলে আমরা বেশি বেশি দু’আ করব? তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহ আর ও বেশি বেশি তোমাদের দু’আ কবুল করবেন। [তিরমিযি: ৩৫৭৩]
মোটকথা হলো, দু’আ এমন এক ইবাদাত, যাহা কখনো বিফলে যায় না। যার মাধ্যমে অন্তত যেকোন একটি ভাল জিনিস হলে ও অর্জিত হয়। আমরা আল্লাহর দরবারে দু’য়া করতে দিন-দিন অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছি। কেননা, আল্লাহর নবী (সা.) বলেন, “সবচেয়ে অক্ষম সে, যে দু’আ করতে অক্ষম।” [সহীহুল জামে: ১০৪৪]
অথচ, তিনি আমাদের জুতার ফিতার ন্যায় একটি নগণ্য জিনিস ছিঁড়ে গেলে ও দয়াময়ের দরবারে দু’আ করার সবক শিখিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, “তোমাদের প্রত্যেকের উচিত তার রবের নিকট তার সকল প্রয়োজনে দু’আ করা। এমনকি; জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলে ও তাঁর নিকট দু’আ করবে।” [তিরমিযি: ৩৬০৪]
আজ আমাদের মুসলিমদের দু’আর দরিয়াটা অনেকাংশে হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা কিংবা তুরাগের মৃত প্রায় নদীর ন্যায়। এই দরিয়ায় আমাদেরকে অচিরেই ফিরিয়ে আনতে হবে পদ্মার জলের ন্যায় কল্লোল। তবে, হৃদয় জমিন সবুজাবৃত হবে দখিনা হাওয়ার শিহরণে।
লেখক পরিচিতি: মুহাম্মদ রিয়াদ উদ্দিন
শিক্ষার্থী তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা
টঙ্গী ক্যাম্পাস।
জন্মস্থান:সুবর্ণচর, নোয়াখালী।
মেইল:muhammadriyaduddin@gmail.com