সুনামগঞ্জে চলছে ২য় দফা স্বল্পমেয়াদী বন্যা : আতংকিত না হওয়ার আহবাণ জেলা প্রশাসনের : মিটামইনে বাধা পেলেও ধনু নদী দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে পানি

নিউজ ডেস্ক | সংবাদ ৫২.কম
আপডেট : ০৬ জুলাই, ২০২৪
Sangbad52

সুনামগঞ্জে চলছে ২য় দফা স্বল্পমেয়াদী বন্যা : আতংকিত না হওয়ার আহবাণ জেলা প্রশাসনের : মিটামইনে বাধা পেলেও ধনু নদী দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে পানি

সুনামগঞ্জ ২ জুলাই,২০২৪ (বাসস) : 

টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে সোমবার (১লা জুলাই) দ্বিতীয় দফায় সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। সুরমা কালনী,কুশিয়ারা,যাদুকাটা নদীসহ সব নদ-নদীর পানি দ্রæত বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতোমধ্যে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। জেলার ধর্মপাশা থেকে মধ্যনগর উপজেলাগামী একমাত্র পাকা সড়কটি এখনও পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। মধ্যনগর থেকে মহেষখলাগামী রাস্তাটিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনাবাজার থেকে সুনামগঞ্জগামী রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ থাকায় নৌকা চলাচল শুরু হয়েছে। সদর উপজেলার ইব্রাহিমপুর থেকে ডলুরাগামী রাস্তাটির সৈয়দপুর পয়েন্টে ডুবে যাওয়ায় উত্তর সুরমা এলাকার লক্ষাধিক মানুষ শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। ঢলের পানি দ্রæত লোকালয়ে প্রবেশ করায় জন জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রথম দফা বন্যায় যারা আশ্রয় কেন্দ্রে ছেড়ে বাড়িতে ফিরছিলেন, তারা প্রায় ২ সপ্তাহের ব্যবধানে আবারও ঘর-বাড়ি ছেড়ে অনেকে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঘরবন্দি মানুষের আর্তনাদ বাড়ছে। গ্রামীণ নলকুপ নিমজ্জিত থাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। দূর্ভোগ যেন ঘিরে ধরেছে হাওর বাসিকে। এদিকে পানিতে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে বিপদসীমার ৮.১২ সেন্টিমিটার, ছাতক পয়েন্টে ৯৫ সেন্টিমিটার,কালনী নদীর দিরাই উপজেলা পয়েন্টে ৬.১৭ সেন্টিমিটার কুশিয়ারা নদীর পানি শাল্লা উপজেলার মার্কুলি পয়েণ্টে ৭.১৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জানা গেছে, তাহিরপুর-বিশ্বম্ভরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের তিনটি পয়েন্ট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়া হাওর ও নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়া অব্যাহত থাকায় অনেক এলাকার নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করে বসত বাড়ি আঙ্গিনায় ঢুকতে শুরু করেছে। ফলে ওইসব এলাকার মানুষজনের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। 

 

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের পশ্চিম ইব্রাহিমপুর গ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহিম আলী বলেন,২২ সালের বন্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে অনাহারে আমার পিতা জারীগানের শিল্পী আশরাফ আলী মারা যান। ৬ দিন বাক্সবন্দী অবস্থায় পিতার লাশ পানিতে বেধে রেখে ৭দিনের ব্যবধানে কোস্টগার্ডের সহায়তায় দাফন করি। এবার ১৭ জুন প্রথম দফা বন্যায় বসতঘর ডুবে গেলে বোনের বাড়ীতে আশ্রয় নেই। ৩দিন আগে ঘরে ফিরে আসি। কিন্তু ১লা জুলাই আবার বসতঘরে পানি উঠলে ২য়বার বসতভিটে ছেড়ে আসি। 'গত দুই দিনের বৃষ্টিপাতে হাওরসহ সব জায়গায় পানি বেড়েছে। ১৩ দিনের ব্যবধানে আবারও ২য় দফা বন্যায় আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি।

 

দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিলন খান বলেন, খাসিয়ামারা নদীর তীরবর্তী নিম্ন অঞ্চলে পানি প্রবেশ করে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানির কারণে গ্রামহীন রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। উপজেলার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই ইউনিয়নের নিচু এলাকা নোয়াগাঁও, রণভূমিসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষের বাড়িতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। 

 

 সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নুরুল হুদা মুকুট বলেন, 'পাহাড়ি ঢলের পানি ক্রমেই বাড়ছে। ইতোমধ্যে তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুর বাজার এলাকার সড়ক প্লাবিত হয়েছে। গত বন্যায় হাওরে পানি টুইটুম্বর থাকায় এবং জেলার ১২ উপজেলায় গত ২ দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টিপাতসহ পাহাড়ি ঢলের পানি এসে মানুষের বসত-বাড়িসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেছে। তবে আমরা প্রশাসন ও রাজনৈতিক দল সম্মিলিতভাবে দুর্যোগের মোকাবেলা করে যাচ্ছি।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার আরও জানান,সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় গেল ২৪ ঘন্টায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গেল ২৪ ঘন্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৪১ মিলিমিটার,গতকাল ছিল ৩১৩ মিলিমিটার। মঙ্গলবার ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ১৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এছাড়াও সুনামগঞ্জে আরও বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়ে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

 

 

ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন,ধর্মপাশা উপজেলায় পানি স্থির রয়েছে। তবে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে ২য় দফা বন্যার মুখোমুখি হতে হবে। 

 

দিরাই উপজেলার মকসুদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা মোমেনা সিদ্দিকা তাপসী বলেন,গত ১৩ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত গ্রীস্মকালীন ছুটির কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বন্ধ ছিল। আগামীকাল ৩ জুলাই বিদ্যালয় চালু হবে। এর মধ্যে খবর পেলাম আমাদের অনেক বিদ্যালয়ের রাস্তায় ও আঙ্গিনায় বন্যার পানি উঠেছে। 

 

মধ্যনগর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা রাসেল আহমদ বলেন,গত ১৭ জুনের সৃষ্ট বন্যায় পানিবন্দী হয়ে এখনও মানবেতর জীবন যাপন করছেন এলাকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। সোমবার ১লা জুলাই সুমেশ্বরী ও উব্দাখালী নদীর পানি ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাই ২ জুলাই থেকে আবারও ২য় দফায় বন্যা শুরু হয়েছে। 

 

২য় দফায় বন্যার ব্যাপারে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের কর্মী সাব্বির আহমদ ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী ফেরদৌস আলম বলেন,৪৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ইটনা-মিঠামইন সড়কটি আমাদের সিলেট-সুনামগঞ্জবাসীর জন্য কাল হয়ে দাড়িয়েছে। এই সেতুর প্রবল বাধার কারণে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি ভৈরবের মেঘনা নদীতে প্রবাহিত হতে পারছেনা। ফলে আমরা বারংবার বন্যার মুখোমুখি হচ্ছি। 

 

তবে পানির গতিপথ বন্ধ করার সাধ্য কারো নেই উল্লেখ করে নেত্রকোনা জেলা সদর নিবাসী মানবাধিকার কর্মী আলহাজ্ব এম মুখলেছুর রহমান খান বলেন, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক শুধু সুনামগঞ্জের জন্য নয় নেত্রকোনা জেলার জন্যও কাল হয়ে দাড়িয়েছে। এই অতীব জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সভায়ও আলাপ হয়েছে। তিনি বলেন,সুনামগঞ্জের সুরমা কালনী ও কুশিয়ারা নদীর পানি এখন ভৈরবের দিকে প্রবাহিত হতে না পেরে নেত্রকোনা জেলার ধনু নদী,সোমেশ্বরী ও বৌলাই নদী দিয়ে নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলা প্লাবিত করে চলেছে। 

 

এদিকে গত বৃহস্পতিবার (২০ জুন) বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শনে সুনামগঞ্জ ও সিলেটে এসে পানি সম্পদ প্রতি মন্ত্রী জাহিদ ফারুক এমপি বলেছিলেন, ইটনা-মিঠামইন সড়কের কারণে পানি আটকে গেলে তা পাস করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, ‘মিঠামইন সড়কের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “নদীর পানি যাতে পাস হতে পারে সে ব্যবস্থা করা হবে। তবে চলতি বর্ষায় এটি ভালোভাবো পরিক্ষা-নিরিক্ষা করে এর পরে পরিকল্পনা নেয়া হবে।

 

সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন,আমরা ১ম দফা বন্যা শুরুর পর থেকে যে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো চালু করেছিলাম সেই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো এখনও চালু আছে। আমরা ভানবাসীদেরকে পুরোদমে ত্রাণসেবা দিয়ে যাচ্ছি। 

 

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) কে বলেন, ১লা জুলাই থেকে আমরা ২য় দফা স্বল্পমেয়াদি বন্যার মুখোমুখি হয়েছি। তবে আগামী ৩দিন চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকলে বন্যার পানি অতিথি পানির মতই ভাটির দিকে চলে যাবে। সুতরাং ২য় দফা বন্যায় আতংকিত হওয়ার কিছুই নেই।